পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে ১৯৭৭ সাল থেকে বামফ্রন্ট সরকারের শাসন শুরু হয়। তারপর থেকেই সাঁওতালি ভাষা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। ভারতবর্ষে একমাত্র বামফ্রন্ট সরকারই প্রথম সাঁওতালি ভাষার সমস্যা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন। এই সরকারের আমলেই প্রাইমারী স্তরের পুস্তক অলচিকি লিপিতে মুদ্রণের পাশাপাশি হড়কো রেন মারে হাপড়াম কো রেয়াঃ কাথা” “শায় সেরমা রেয়াঃ অনড়হেঁ” “সাধু রামাদঅনলমালা” “মিৎশায় মিৎকাহনী” ইত্যাদি পুস্তক মুদ্রিত হয়। এছাড়াও সাঁওতাল বিদ্রোহের স্মরণে ‘হুল দিবাস” পালন, কবি সাধু রামাদ মুরমু জন্ম শতবার্ষিকী পালন, সাধু রামচাঁদ স্মৃতি পুরষ্কার প্রদান, সাঁওতালি নাটক প্রতিযােগিতা, রঘুনাথ মুরমু স্মৃতি পুরষ্কার প্রদান, লাল শুকরা ওঁরাং স্মৃতি পুরষ্কার প্রদান শুরু হয়।
১৯৭৭ সালে সাঁওতালি ভাষা চর্চা ও বিকাশের পদক্ষেপ হিসেবে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাঁওতালি ভাষায় পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা চালু হয়। তৎকালীন উপাচার্য ড. সুরজিৎ সিন্হা-র তত্ত্বাবধানে সাঁওতালি ভাষায় Certificate কোর্স চালু হয়। শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন বরকা সবেন। বছর দুয়েক পর বিশ্বভারতীতেই সাঁওতালি ভাষায় Diploma কোর্স চালু হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই কোর্স ছিল অ-সাঁওতাল ছাত্রছাত্রীদের জন্য। প্রথমদিকে বঙ্গ অসাঁওতাল স্থৰতাত্রী কৃতিত্বের সঙ্গে Certifi-cate ও Diploma কোর্সে উস্তীর্ণ হয়েছেন। ক্রমশঃ এই বিভাগে ছাত্রছাত্রীর অভাব দেখা দেওয়ায় এটিকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ সাঁওতালি ভাষা অষ্টম তফশীলে অন্তর্ভুক্ত হবার পর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাঁওতালি ভাষায় ডিগ্রী কোর্স চালু হয়।
আকাশবাণী কোলকাতার সাঁওতালি অনুষ্ঠানে যে খবর প্রচার শুরু হয় তাতে ১৯৭৭ সালের নভেম্বরের তিন তারিখ থেকে স্থায়ী ভাবে একজন সংবাদ পাঠকের নিয়ােগ হয়। ইনি হরপ্রসাদ মুরমু। এই বছরেই অর্থাৎ ১৯৭৭ সালেই যদুনাথ টুড়
প্রযােজিত এবং সমীর কুমার মুরমু লিখিত নাটক “টুআর’ আকাশবাণী অ্যানুয়াল এয়ার্ড প্রতিযােগিতায় (সর্বভারতীয় স্তরে) প্রথম স্থান অধিকার করে। সাঁওতালি ভাষার নাট্যকার ও শিল্পীদের মধ্যে এ ঘটনা গভীর অনুপ্রেরণা জোগায়। এটিকে ভাষা চর্চা ও বিকাশের একটি অন্যতম পদক্ষেপ হিসেবে অবশ্যই বলা যায়।
১৯৭৭ সালে “লাংতিতি” নামে একটি পত্রিকার প্রকাশ শুরু হয়। ঝাড়খণ্ড রাজ্যের জামতাড়া জেলার (তৎকালীন দুমকা) বেওয়া থেকে প্রকাশিত হত। পত্রিকাটির সম্পাদক শিব কুমার রাপাজ। গুরুদাস মুরমু সম্পাদিত “খেরওয়াল জারপা” নামে একটি পত্রিকা এই সালে অর্থাৎ ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত হয়। এটি পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার কাকাটিয়া ডাকঘরের অধীন চঁাদান কিয়ারী গ্রাম থেকে প্রকাশিত হত।
১৯৭৭ সালে ‘সাকওয়া” নামে পত্রিকার প্রকাশ শুরু হয়। এটি বিহার রাজ্যের (বর্তমানে ঝাড়খণ্ড) সিংভূম (পূর্ব) জেলার ঘাটশীলা ডাকঘরের অধীন পাওয়া থেকে প্রকাশিত হত। সম্পাদক ছিলেন গােবিন্দ সরেন।
এতদিনে অলচিকি আন্দোলন নিজস্ব গতিপথ পেয়ে জোরদার হয়ে ওঠে, বলিষ্ঠ হয়ে ওঠে। হাজার হাজার সাঁওতাল আসেকার নেতৃত্বে অলচিকি-কে নিজস্ব ভাষার লিপি হিসেবে মেনে নিয়ে তা স্বীকৃতির দাবী তােলে। আন্দোলন দানা বাঁধে। অলচিকি লিপির প্রাধান্য থাকলেও এই আন্দোলনকে ভাষা আন্দোলনেরই অংশ হিসেবে ধরা যায়। ১৯৭৮ সালে আনুমানিক ৮০ হাজার সাঁওতাল অলচিকি স্বীকৃতির দাবীতে কোলকাতা মহানগরীতে জমায়েত হয়। এই সময়ে প্রখ্যাত সাঁওতালি কবি সারদা প্রসাদ কি বলেছিলেন (যদিও এর লিখিত রূপ কোথাও পাওয়া যায় না) যে, অলচিকি বা লিপির স্বীকৃতির দাবী না তুলে সাঁওতালি ভাষার স্বীকৃতির দাবী তােলা হােক। সেই সময়ে সারদাবাবুর এই কথাকে কেউ ই আমল দেয়নি। তবু বলা যায়, আসেকার নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন একটি কাঠামাে পায়।
১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় “জিরিহিরি’ নামক পত্রিকা। সম্পাদক বালিশ্বর সৱেন। পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার জামতােড়িয়া ডাকঘরের অধীন মুকুন্দপুর গ্রাম থেকে একটি প্রকাশিত হত। এ বছরই নিরঞ্জন সরেন সম্পাদিত “তাপান দাঃ” পত্রিকার প্রকাশ শুরু হয়। পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার ফতেপুর সিদ্ৰী ডাকঘরের অধীন বাবুইজোড় গ্রাম থেকে এটি প্রকাশিত হত।
১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় “জানটাঃ” পত্রিকা। এটি ভুবনেশ্বর কলেজের সাঁওতাল পড়ুয়ারা প্রকাশ করতেন। সম্পাদকের নাম জানা যায়নি। গিরিজল মুরমু সম্পাদিত “উমুল” পত্রিকাও ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয়।পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার কুটনী ডাকঘরের অধীন ঝরিয়াডি গ্রাম থেকে প্রকাশিত সাঁওতালি ভাষার লিপি নিয়ে তুমুল বিতর্ক থাকলেও অলচিকির সমর্থনে আন্দোলনের জোয়ার প্রবল থাকায় পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার অলচিকি লিপিকে সাঁওতালি ভাষার উপযােগী মনে করে ১৯৭৯ সালের জুন মাসের দুই তারিখে নীতিগত ভাবে স্বীকৃতি দেন। পশ্চিমবঙ্গের সাঁওতাল সমাজে আলােড়ন সৃষ্টি হয়। পরােক্ষে ভাষা আন্দোলন শক্ত মাটি খুঁজে পায় ও আন্দোলন জোরদার হয়।
১৯৭৯ সালে প্রকাশিত পত্রিকাগুলি হল –
১) “চিরগৗল”। সম্পাদক বাদল কিন্তু। পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার খন্ন্যান থেকে এটি প্রকাশিত হত।
২) “হিহিড়ি পিপিড়ি”। সম্পাদক সনাতন সরেন। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার হিন্দুস্থান কেবল থেকে প্রকাশিত হত।
৩) ‘বির সেঁগেল”। সম্পাদক শিব যতন কিস্কু। বিহার রাজ্যের তৎকালীন সাঁওতাল পরগণার গােড়া থেকে প্রকাশিত হত।
৪) “টুআর”। সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ সরেন। পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর (বর্তমানেপশ্চিম মেদিনীপুর, এখন ঝাড়গ্রাম) জেলার বিনপুর থেকে প্রকাশিত হত।
এই বইটি লিখেছেন – পরিমল হেমব্রম
















Leave a Reply